তিনটি কৌশলগত উদ্যোগ চীনের বিআরআই, জাপানের বিগ বি ও যুক্তরাষ্ট্রের আইপিএস নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক উন্নয়নের যেকোনো উদ্যোগকে বাংলাদেশ স্বাগত জানায়। এ ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য হবে ব্যবসা, বিনিয়োগ ও অর্থনীতি। তবে কোনো উদ্যোগে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার উপাদান থাকলে তা থেকে দূরে থাকবে বাংলাদেশ। এটাই বাংলাদেশের মূলনীতি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিআরআই, বিগ বি এবং আইপিএসের বিষয়ে বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থান ঠিক করতে ২০১৮ সালের শেষার্ধে মন্ত্রণালয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। কথা ছিল, মন্ত্রণালয় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এ বিষয়ে একটি সুপারিশ জমা দেবে। কয়েক দফা আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো অবস্থান ঠিক করতে পারেনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের (এসআইপিজি) জ্যেষ্ঠ ফেলো মো. শহীদুল হক গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভূরাজনৈতিক মেরুকরণের বিষয়ে খুব দীর্ঘ সময় না নিয়ে, নির্দিষ্ট একটি সময়ের মধ্যে একটি বাস্তবসম্মত এবং ভারসাম্যমূলক অবস্থান নিতে হবে বাংলাদেশকে। আগামী কয়েক বছর ধরে বিশ্ব নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে এগোতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখতে হবে কাউকে যেমন অসন্তুষ্ট করা যাবে না, তেমনি আবার স্বার্থও জলাঞ্জলি দেওয়া যাবে না। ভৌগোলিক অবস্থানের সুফল আদায়টা নিশ্চিত করতে হবে। চীনের সঙ্গে দর–কষাকষির জায়গা কোথায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কী নিয়ে হবে, জাপানের সঙ্গে কোথায় দর–কষাকষি হবে, সেই প্রস্তুতিটাও বাংলাদেশের নিয়ে রাখতে হবে।’
ভারসাম্য ও অগ্রাধিকারে জোর
একাধিক জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, ২০১৮ সাল থেকে জাপান বলছে, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিগ বিতে যুক্ত হয়েছে। অথচ বিগ বি–ভিত্তিক মহাপরিকল্পনার দলিলে মাতারবাড়ীর কোনো উল্লেখ ছিল না। ফলে জাপানের এমন দাবি বাংলাদেশকে অবাক করেছে। আবার ২০১৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র বলে আসছে, জাপানের মাতারবাড়ী প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ রয়েছে। জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির পর বাংলাদেশের কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এ সিদ্ধান্তে আসেন যে এরপর থেকে যেকোনো উদ্যোগে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে লিখিত থাকতে হবে।
এদিকে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ভূরাজনৈতিক মেরুকরণের বাস্তবতায় বসবাস করেও বাংলাদেশের পক্ষে ভারসাম্যমূলক অবস্থান বজায় রাখা সম্ভব। তবে ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে দর–কষাকষির সুযোগ যাতে নষ্ট না হয়, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভূকৌশলগত সুবিধা কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশের স্বার্থে ভূ–অর্থনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে, এমন কোনো মনোভাব না দেখানোই বাংলাদেশের জন্য ভালো।