
আসিফ হাওলাদর।দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে দিন দিন প্রবাল কমছে। কমছে দ্বীপের বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকাও। বিপরীতে বাড়ছে পর্যটক। তাঁদের আবাসনের জন্য নতুন হোটেল ও অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে।
দ্বীপে স্থায়ীভাবে বসবাস করা জনসংখ্যাও বাড়তি, যা চাপ ফেলছে দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের ওপর। সব মিলিয়ে সেন্ট মার্টিনের অনন্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক ও এক শিক্ষার্থীর এক গবেষণায় উঠে এসেছে সেন্ট মার্টিনের দুর্দশার এ চিত্র। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, চার দশক আগে দ্বীপটির যতটুকু ভূমি প্রবালে আচ্ছাদিত ছিল, তার তিন ভাগের এক ভাগও এখন অবশিষ্ট নেই। কোরাল বা প্রবাল—এক ধরনের অমেরুদণ্ডী সামুদ্রিক প্রাণী। বহিরাবরণ শক্ত হওয়ার কারণে অনেক সময় একে ভুল করে পাথর ভাবা হয়। পলিপ নামের অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীর সমন্বয়ে তৈরি হয় একটি প্রবাল।
গবেষণা নিবন্ধটির অন্যতম লেখক মো. ইউসুফ গাজী বলেন, ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে ২০৪৫ সালের মধ্যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি পুরোপুরি প্রবালশূন্য হয়ে যাবে। আমরা তখন হয়তো দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন কথাটিও বলতে পারব না। প্রবাল শুধু জাদুঘরেই পাওয়া যাবে।’
সেন্ট মার্টিন কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে সাগরবক্ষে বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ। প্রশাসনিকভাবে দ্বীপটি কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার একটি ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নে গ্রাম আছে ৯টি। সরকারি তথ্যে দ্বীপের আয়তন ১৩ বর্গকিলোমিটার উল্লেখ রয়েছে। তবে গবেষণায় বলা হয়েছে ৮ বর্গকিলোমিটার। সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নূর আহমেদ গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, দ্বীপের চারদিকে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর ধরে ভাঙনের কারণে দ্বীপের আয়তনও কমেছে। এই দ্বীপকে রক্ষায় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের ভিত্তিতে দ্রুত বাঁধ নির্মাণ করা দরকার। তিনি বলেন, এই দ্বীপের প্রবাল, শৈবাল রক্ষায় সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। তবে দুই বছর ধরে স্থানীয়ভাবে প্রবাল উত্তোলন ও পাচার বন্ধে তাঁরা কাজ করছেন। এ ছাড়া পর্যটকেরা যে পরিমাণ বর্জ্য ফেলে যান, তা অপসারণে সরকারি কোনো বারাদ্দ ও ব্যবস্থা নেই। এসব বর্জ্য সাগরে গিয়ে পড়ে।
সেন্ট মার্টিনের তুলনামূলক চিত্র বুঝতে গবেষকেরা স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করেন। ছবিগুলো ১৯৮০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ের। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে গবেষণা করা হয়। দেখা যায়, ৩৮ বছরে দ্বীপটিতে প্রবাল আচ্ছাদন ১ দশমিক ৩২ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে শূন্য দশমিক ৩৯ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। প্রবাল প্রজাতি ১৪১টি থেকে কমে ৪০টিতে নেমেছে। বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সাড়ে ৪ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে নেমেছে ৩ বর্গকিলোমিটারে।
গবেষণায় সেন্ট মার্টিনের পরিবেশদূষণ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির জন্য কয়েকটি মানবসৃষ্ট কারণ চিহ্নিত করা হয়। যার মধ্যে অন্যতম অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন, আবাসিক হোটেলগুলোর দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পর্যটকদের ব্যবহৃত সামগ্রী সমুদ্রের পানিতে নিক্ষেপ, পাথর উত্তোলন, প্রবাল উত্তোলন ও উপকূলীয় এলাকায় মাছ ধরার জালের যত্রতত্র ব্যবহার। গবেষকেরা আরও বলেছেন, সেন্ট মার্টিনে নতুন জন্মানো প্রবালগুলো জেলেদের জালের টানে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জেলেরা দ্বীপের চারপাশে তীর থেকে প্রায় ৫০০ থেকে ১ হাজার মিটার উপকূলবর্তী এলাকায় জাল ফেলে মাছ ধরেন, যেখানে সবচেয়ে বেশি প্রবালের জন্ম হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণাটির আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) একাধিক গবেষণায় একই ধরনের চিত্র উঠে আসে। ওই সব গবেষণায় দ্বীপটিকে রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে সেখানে পর্যটকদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু কাজ খুব একটা হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ূন আখতার বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ জীববৈচিত্র্যের দিক দিয়ে পৃথিবীর মধ্যেই অনন্য। সেখানে স্বচ্ছ পানির কারণে প্রবাল জন্ম নেয়। নির্বিচার পর্যটক যেতে দিয়ে পানি দূষিত করে ফেলা হয়েছে। সেন্ট মার্টিনকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে এর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।